সংসার চালানোর জন্য মাকে একটি প্রাথমিক স্কুলে রান্না করতে হতো। একদিন শিক্ষকদের কাছে থেকে আমার লেখাপড়ার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তিনি ক্লাসে আসেন। যখন তিনি স্যারের সাথে কথা বলছিলেন লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে যাচ্ছিল। মনে মনে তাকে গালমন্দ করছিলাম আর অভিশাপ দিচ্ছিলাম।
পরদিন স্কুলে গেলে আমার এক সহপাঠী এসে বলল, 'গতকাল একচোখ কানা যে মহিলা বাবুর্চি এসেছিল, সে কি তোর মা?'
একথা শুনে লজ্জায় আমি মরেই যাচ্ছিলাম। মেজাজ খারাপ করে বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, 'তুমি নিজের এই বিদঘুটে চেহারা দেখিয়ে আমাকে সবার সামনে অপদস্থ করেছ। দয়া করে জাহান্নামে গিয়ে আমাকে মুক্তি দাও। তোমার মতো একচোখা কানা মা থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো।
সেদিন তাকে অনেক অপমান করেছিলাম; কিন্তু তিনি একটি কথারও জবাব দেননি। চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন আমার কথাগুলো। আমার কথা শেষ হলে তিনি খুব নম্রভাবে আমার সামনে থেকে চলে যান। এরকম উদ্ধত আচরণের জন্যও সেদিন আমি অনুতপ্ত হইনি। কেন জানি, তাকে দেখলেই আমার বিরক্তি লাগত।
আমি শুধু নিজের কথাই চিন্তা করতাম। ভাবতাম, পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরি পেলে তাকে ফেলে দূরে কোথাও চলে যাবো। নিজে একা একা অনেক সুখে শান্তিতে থাকব; কিন্তু এত অপমানের পরও মা সবসময় আমাকে নিয়ে এবং আমার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তা করতেন।
কঠোর পরিশ্রম করে একটা পর্যায়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমি প্রথম স্থান অর্জন করি। সিঙ্গাপুরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য বৃত্তিও পেয়ে যাই। সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে আসি। ভালো একটা চাকুরি পাই। বিয়ে করি। আর, বিশাল একটি বাড়ি কিনে সেখানেই সুখে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছিলাম। মায়ের কথা কখনো চিন্তাও করিনি। তাছাড়া তাকে দেখারও কোনো ইচ্ছে হয়নি কখনো। আমার স্ত্রী-সন্তানদের সাথে দেখা করার জন্যও কখনো আসতে বলিনি তাকে। এমনকি আমার সন্তানরা জানতও না যে, তাদের দাদী জীবিত আছেন।
আমার মাও অনেক দিন আমার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেননি। সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি তাকে ঘৃণা করি। তাকে মোটেও পছন্দ করি না; কিন্তু মায়ের মনে সবসময়ই সন্তানের জন্য একটা টান থাকে। একদিন ঠিকানা যোগাড় করে তিনি ঠিকই আমার বাড়িতে চলে এলেন। বাড়ির দরজায় আসামাত্র আমার সন্তানরা আমার অন্ধ মাকে দেখে হাসতে শুরু করল।
আমি বেরিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে খুব অপমান করলাম। বললাম, 'কী আশ্চর্য! তুমি আমার বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছ? সারাজীবন তোমার জন্য আমি লাঞ্ছিত হয়েছি, অপমান সহ্য করেছি। এখন একটু সুখে শান্তিতে আছি, তাও কি তোমার সহ্য হচ্ছে না। তুমি কি তোমার কুৎসিত চেহারা দেখিয়ে আমার সন্তানদের ভয় দেখাতে এসেছ?
তিনি শান্ত গলায় বললেন, 'ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছি, বাবা। ভুলে রাস্তা হারিয়ে এখানে চলে এসেছি। আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি।' এই বলে তিনি আর অপেক্ষা না করে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলেন। বয়সের ভারে ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে তাঁর হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। তবুও, তাঁর সেই কষ্ট আমার ভেতরে একটুও আলোড়ন সৃষ্টি করেনি সেদিন।
একদিন স্কুল থেকে প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনীর নিমন্ত্রণ পেলাম। আমার জানামতে, মা তখনো স্কুলের বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন। স্ত্রীর কাছে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা বলে স্কুলের পুনর্মিলনীতে চলে এলাম। কৌতূহলবশত আমার আগের প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করে পুরাতন বাড়ির খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছে জাগল মনে। তবুও মাকে দেখার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। বাড়ি গিয়ে যখন প্রতিবেশীদের মুখে শুনলাম মা মারা গেছেন। আমি মোটেও দুঃখিত হইনি। একফোঁটা চোখের পানিও পড়েনি আমার। এক প্রতিবেশী এসে বলল, মা নাকি মারা যাবার আগে আমার জন্য একটা চিঠি রেখে গেছেন। প্রতিবেশী আমার হাতে চিঠিটা দিলে আমার খুলে পড়ার কোনো ইচ্ছে-ই জাগছিল না। কী আর লিখবে বুড়িটা? সম্ভবত আমাকে আচ্ছামতো অভিশাপ দিয়েছে; কিন্তু কী মনে করে যেন চিঠিটা খুলে ফেললাম এবং পড়তেও শুরু করলাম :
‘প্রিয় পুত্র, আমি মন থেকে চাইতাম, তুমি পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হও। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হও। আজ তুমি সচ্ছল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ। অনেকদিন ধরে তোমাকে দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই সেদিন কিছু না জানিয়েই তোমার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। তোমার সন্তানদের ভয় দেখানোর জন্য আমি দুঃখিত। আমি বুঝে উঠতে পারিনি। এমন অন্যায় কাজ করায় নিজেকে অনেক তিরস্কার করেছি আমি। তুমি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আসবে শুনে খুবই খুশি হয়েছি। ভাবছিলাম, তোমাকে এক নজর দেখতে পাবো; কিন্তু পরে মনে হলো, স্কুলে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, আমি চাই না, আমার জন্য আর কখনো তুমি মানুষের সামনে বিব্রত হও। এদিকে বিছানা থেকে ওঠার মতো শক্তিও আমার নেই। এতটা বছর একটি কথা আমি নিজের মধ্যেই চেপে রেখেছিলাম। আজ তোমাকে সেই গোপন কথাটি বলছি, ছোটবেলায় তোমার একটি দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় তোমার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। বাবা আমার, ছেলের এক চোখ নষ্ট হওয়া সহ্য করা পৃথিবীর কোনো মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাছাড়া, চোখ হারিয়ে তোমার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল। ভালোমতো চলাফেরাও করতে পারছিলে না। তোমার সেই অবস্থা দেখে আমি অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছিলাম; কিন্তু টাকা দিয়ে চোখ কিনে তোমার অপারেশান করানোর সামর্থ্যও আমার ছিল না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে নিজেরই এক চোখ তোমাকে দান করেছিলাম যেন জীবনে তোমার কোনো কষ্ট না হয়। এরপর অপারেশন করে ডাক্তার আমার এক চোখ তুলে তোমাকে দিয়েছিলেন। তোমাকে এক চোখ দিতে পেরে আমি যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম তা যদি তুমি জানতে! যখনই ভাবনায় আসত যে, আমার সন্তান আমার চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখবে তখন যে কী পরিমাণ ভালো লাগত তা বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। জানি না, তোমার সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে কি না। তবুও দু'আ করি, যেখানেই থাকো, আল্লাহ তোমাকে সুস্থ রাখুন।
মন্তব্যসমূহ