মায়ের চিঠি


প্রিয় খোকা,
বেশ কিছুদিন ধরে তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। ঘুরেফিরে কেবল পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলোই চোখের সামনে ভেসে উঠছে বার বার। তখন সময়টা ছিল বিয়ের প্রায় বছর দেড়েক পর। একজন নারী তার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় যে সংবাদ পেতে পারে, সেই সংবাদ আমিও পেয়েছিলাম। তুমি জানো, কী ছিল সেই সংবাদ—যা আমাকে জীবনের পরম আনন্দে ভাসিয়েছিল? সেটা ছিল তোমার অস্তিত্বের সংবাদ। আমাকে বলা হয়েছিল, আমার গর্ভে তুমি এসেছ। বাবা আমার, আমি তোমাকে কোনোভাবেই সেই মুহূর্তের কথা বলে বোঝাতে পারবো না। আমার গর্ভে তোমার অস্তিত্বের সংবাদ যে আমাকে কী রকম আনন্দের প্লাবনে ভাসিয়েছে—সেটা তুমি কোনোদিনও বুঝবে না।

তারপর অনেকগুলো সপ্তাহ কেটে গেল। আমার শরীরে আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসতে লাগল। শরীরের এই পরিবর্তনের সাথে সাথে আমি ভয়ও পাচ্ছিলাম। কারণ, আমি যা-ই খেতাম তা-ই বমি হয়ে যেত। প্রচণ্ড দুর্বলতা এসে আমার শরীরে ভর করতে লাগল। তুমি বড় হওয়ার সাথে সাথে আমার শরীরও দিন দিন বড় হতে লাগল। আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, তুমি গর্ভে আসার পর আমার শারীরিক দুর্বলতা, অসহনীয় ব্যথা, খেতে বা ঘুমোতে না পারা সত্ত্বেও যতই দিন গড়াচ্ছিল, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ততই বেড়ে চলছিল।

আমার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্নে সবখানে শুধু তুমি আর তুমি। এভাবে দিনগুলো সপ্তাহ আর। সপ্তাহগুলো মাসে পরিণত হতে লাগল। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমিও যেন ভারী হয়ে গেলাম। আমি এত বেশিই ভারী হয়ে উঠলাম যে, কোথাও বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারতাম না। এরপর এমন একটা সময় এলো যখন আমি চিৎ হয়ে ঘুমাতেও পারতাম না। কেন জানো? কারণ, তোমার ওজন আমার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা তৈরি করত। তাই আমি পাশ ফিরে ঘুমাতাম। তবুও আমার ভেতরে একটা ভয় কাজ করত। ভাবতাম, পাশ ফিরে ঘুমাতে গিয়ে আবার তোমার গায়ে কোনো আঘাত লাগে কি না! তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে যায় কি না সারাক্ষণ এই ভয় আমার ভেতরে কাজ করত। এই আশংকা নিয়েই কত রাত আমার নির্ঘুম কেটে গেছে—তুমি জানো না। কত বিচিত্র আর ভালোলাগার ছিল সেই প্রহরগুলো।

এভাবেই দিন যত যাচ্ছিল, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তত বাড়ছিল। তোমার প্রতি আমি আরও বেশি মনোযোগী, আরও বেশি যত্নশীল হয়ে উঠছিলাম। তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে আমার তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। আমি নীরবে কান পেতে শুনতাম। তুমি কোনো শব্দ করছ কি না, নড়াচড়া করছ কি না। যখনই তুমি নড়ে উঠতে, আল্লাহর কসম, মনে হতো— আমি যেন তখনই মারা যাবো। প্রচন্ড ব্যথায় আমি কুঁকড়ে উঠতাম। আমি যেন নিজের ভেতর নিজেই গুটিয়ে যেতাম। বিশ্বাস করো, মুখের ভেতর কাপড় গুঁজে সেই ব্যথা আমি কত শত বার নিজের ভেতরে চাপা দিয়ে দিয়েছি। কাউকে জানতেও দিইনি। কেন জানো? শুধু তোমার জন্য।

এরপর... একদিন সেই সময়টা এলো। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! সেদিন আমি এমন এক ব্যথা অনুভব করলাম—যা আমি এর আগে কখনো অনুভব করিনি। এমন এক ব্যথা—যার কারণে আমার মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি মারাই যাব। ব্যথার পর ব্যথা! চাপের পর চাপ! সেকেন্ডের পর সেকেন্ড! মিনিটের পর মিনিট! আল্লাহর কসম, সেই সময়টাকে আমার সারা জীবনের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। সেই মৃত্যুসম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম; বিশ্বাস করো, তখনোও একটি বারের জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিইনি। এক মুহূর্তের জন্যও আমি তোমাকে দোষারোপ করিনি; বরং সে সময়েও আমি এক অন্যরকম আশা, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছের কাছে জগতের সকল যন্ত্রণা, সকল ব্যথা যেন পরাজিত হয়ে গেল। অপরিসীম ভালোবাসা, আদর আর মায়াভর্তি এক হৃদয় নিয়ে আমি তোমার জন্য প্রহর গুনছিলাম।

অতঃপর তুমি পৃথিবীতে এলে। শপথ সেই সত্তার—যার হাতে আমার প্রাণ, তোমার চেহারা দেখামাত্রই সকল যন্ত্রণা, সকল দুঃখ-ব্যথা যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেল। এতক্ষণ যে ব্যথা আমার কাছে মৃত্যুসম মনে হচ্ছিল, সেটা যেন কর্পূরের মতো কোথায় উবে গেল এবং আমার দু'চোখে ব্যথা আর যন্ত্রণার যে অশ্রু ছিল, মুহূর্তেই সেটা আনন্দের অশ্রুতে পরিণত হলো। যখন আমি তোমাকে ধরলাম এবং বুকে টেনে নিলাম, আমি হাসলাম আর বললাম, – 'সুবহানা রাব্বিয়াল আ'লা!' আল্লাহ আমাদের এক মহা আশীর্বাদ দান করেছেন। এক মহা নি'য়ামাত দান করেছেন।

প্রিয় সন্তান, এরপর সেই নির্ঘুম রাতগুলোর গল্প কি তুমি শুনবে না? তুমি জান, কেন সেই রাতগুলো আমার নির্ঘুম কেটেছিল? তোমার জন্যে। কারণ, আমি সহ্য করতে পারতাম না তোমার এতটুকু কান্নাও। তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কত রজনী আমি কাটিয়ে দিয়েছি—সে হিসেব আর নাইবা দিলাম তোমায়। দিনের বেলায় তোমার দেখাশোনা করে আমি এত ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, আমি এতই ভেঙে পড়তাম যে, মন না চাইতেই শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতাম; কিন্তু যখনই তুমি আমার পাশ থেকে শব্দ করে উঠতে, আমি হুড়মুড় করে উঠে যেতাম। আমি দিগ্বিদিক শূন্য নয়নে তোমাকে খুঁজে নিতাম।

আস্তে আস্তে তুমি বড় হতে লাগলে। যখন তুমি হামাগুড়ি দিতে, আমি সেই দৃশ্য দেখে হেসে কুটি কুটি হতাম। যখন তুমি আমার আঙুল ধরে ধরে হাঁটতে শিখছিলে, তখন আমি মনের ভেতর কি যে এক পুলক অনুভব করতাম—তা তুমি বুঝরে না। এবং তারপর... তারপর এমন একটা দিন এলো— যা আমার জন্য সত্যিই কঠিন ছিল। এটা ছিল সেই দিন যেদিন তোমাকে প্রথম স্কুলে দিয়ে আসলাম। তোমাকে যখন স্কুলে রেখে আসছিলাম, তখন তুমি হাউমাউ করে কাঁদছিলে। এই প্রথম আমার চোখের আড়াল হলে তুমি। বিশ্বাস করো, তোমার সাথে সাথে আমিও সেদিন কেঁদেছিলাম; তবুও সেই কান্নাকে আমি বাস্তবতার উপর প্রাধান্য দিইনি। আমি জানতাম, এখানে তোমাকে পড়তেই হবে। কষ্ট হলেও থাকতেই হবে, এবং এটাই তোমার জন্য উত্তম। তোমার কল্যাণের কথা ভেবে আমি সেদিন আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম।

এরপর, বছরগুলো দ্রুতই কেটে গেল এবং তুমি সেই স্কুলে বড় হয়ে উঠলে। পড়াশোনা শেষে তুমি স্বনির্ভর হলে। নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে শিখলে। নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেলে।

এরপর... এরপর তোমার জীবনে এমন এক দিন এলো—যেদিন আমি তোমার জন্য অত্যন্ত আনন্দিত ছিলাম, আবার একইসাথে আমার প্রচুর দুঃখবোধও হচ্ছিল। যখন তুমি বিয়ে করার মতো কাউকে খুঁজে পেলে, তোমার খুশি দেখে আমার কি যে আনন্দ হচ্ছিল—তা লিখে বোঝাতে পারবো না; কিন্তু বাবা, একইসাথে আমার অনেক খারাপও লাগছিল সেদিন। এই ভেবে, অল্প যে কয়েকটা জিনিস এতদিন আমি তোমার জন্য করতে ভালোবাসতাম, এখন থেকে সেগুলি অন্য কেউ তোমার জন্য করে দেবে। তবুও তোমাকে খুশি থাকতে দেখলে জগতে আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হই। তোমার আনন্দ, তোমার ভালোলাগা আমাকে অন্যরকম শিহরণ দেয়। আমি তোমার মা! তোমাকে আমি দশটা মাস গর্ভে ধারণ করেছি। এক মৃত্যুসম ব্যথা-যন্ত্রণা আর কষ্ট নিয়ে আমি তোমাকে দুনিয়ার আলো দেখিয়েছি। বুকের দুধ খাইয়ে তোমাকে বড় করেছি। সমস্ত বিপদের সময় তোমাকে বুকে আগলে রেখেছি। পরম যত্নে। পরম মমতায়।

কিন্তু বাবা, যখন তোমার কাছে নতুন কেউ এলো, যখন তুমি সঙ্গী হিসেবে নতুন কাউকে পেয়ে গেলে, আমি তোমার কাছে কেমন যেন অবহেলার বস্তু হয়ে গেলাম। ছোট্টবেলায় খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে যখন তুমি আমার কাছে আসতে, আমি আমার আঁচল দিয়ে তোমার চোখের জল মুছে দিতাম। বুকে জড়িয়ে ধরে ব্যথার জায়গায় মালিশ করে দিতাম। আজ যখন তুমি বড় হয়ে উঠলে, তোমার ব্যথার কথা তুমি আর আমাকে শোনাও না, কান্নাভেজা চোখে আমার কাছে ছুটে আসো না, আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার আঁচলে মুখ লুকাও না। তোমার আনন্দের খবরগুলোও আমি আর জানতে পারি না।

বাবা, ভেবো না আমি আজ অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসেছি। ওয়াল্লাহি, তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি তোমার মা। পৃথিবীর কোনো মা-ই তার সন্তানের প্রতি অভিযোগ জমা রাখতে পারে না। আমিও পারিনি। শুধু চাই, তুমি ভালো থাকো। অনেক ভালো। শুভ কামনা তোমার জন্য।

বই: মা মা মা এবং বাবা

মন্তব্যসমূহ